রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রণক্ষেত্র: ৭ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শিক্ষার্থী ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে শুরু হওয়া সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সাত প্লাটুন সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। বিজিবি সদস্যরা বর্তমানে বিনোদপুর বাজারে অবস্থান করছেন।
বিজিবির রাজশাহীর ১ ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাব্বির আহমেদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি ৭ প্লাটুন বিজিবি সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁরা ক্যাম্পাসের বাইরে আছেন। পরিস্থিতি বুঝে তাঁরা নির্দেশনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন।
এদিকে সন্ধ্যায় শুরু হওয়া সংঘর্ষ রাত ১১টা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তুমুল সংঘর্ষে এরই মধ্যে দুই পক্ষের দুই শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। আহতদের বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী।
রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতানুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের সামনে সাংবাদিকদের সামনে দাবি করেছেন, এই সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বগুড়া থেকে মোহাম্মদ পরিবহনের একটি বাসে রাজশাহী আসছিলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী। বাসে সিটে বসাকে কেন্দ্র করে গাড়িচালক শরিফুল ও তাঁর সহযোগী রিপনের সঙ্গে তাঁর কথা-কাটাকাটি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিনোদপুর বাজারে বাস থেকে নামার সময় তাঁদের আবারও কথা-কাটাকাটি হয়। এ সময় বিনোদপুর বাজারের একজন ব্যবসায়ী বাস চালকের পক্ষ নিয়ে কথা বলেন। তখন শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাঁর হাতাহাতি হয়।
খবর পেয়ে সেখানে যান বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া। এ সময় ব্যবসায়ীরা তাঁর মোটরসাইকেলটি ভাঙচুর করেন। ধাওয়া দিয়ে তাঁকে ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
এতেই ঘটনা বড় হয়ে যায়। সাধারণ শিক্ষার্থীরা আবাসিক হল থেকে বের হয়ে বিনোদপুর গেটের পাশে অবস্থান নেন। আর ব্যবসায়ীরা অবস্থান নেন রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কে বিনোদপুর বাজারে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে লক্ষ্য করে অন্ধকারের ভেতর ইট পাটকেল ছুড়তে থাকে। শতশত শিক্ষার্থীর ভিড়ের মধ্যে পড়া ইটে অনেক শিক্ষার্থী আহত হন। এপারে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও আহত হন অন্তত ১০ জন।
আহতদের মধ্যে ক্যাম্পাসে কর্মরত কয়েকজন সাংবাদিকও রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আহতদের সংখ্যা দুই শতাধিক দাবি করা হলেও রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গেছেন ৩৮ জন। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে এটি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
রাবি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষে বিনোদপুর রণক্ষেত্ররাবি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষে বিনোদপুর রণক্ষেত্র। ছবি: আজকের পত্রিকা
এদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে সন্ধ্যার পরেই ঘটনাস্থলে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য যান। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তাঁরা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কোনো চেষ্টা করেননি। রাত ৮টার দিকে বিনোদপুর গেটের পাশে থাকা পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিনোদপুর বাজারের বেশ কয়েকটি দোকানেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মুহূর্তেই বিনোদপুর বাজারে সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক।
ওই সময় অন্ধকারের ভেতর বিনোদপুর বাজার থেকে ক্যাম্পাসের দিকে মুহুর্মুহু ইট পাটকেল নিক্ষেপ করতে দেখা যায় ব্যবসায়ীদের। ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে বিনোদপুর বাজারের দিকে অসংখ্য পেট্রোল বোমা উড়ে আসতে দেখা যায়। ক্যাম্পাসের আবাসিক হলগুলো থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও লাঠিসোটা এবং অন্যান্য দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়।
এই পরিস্থিতিতে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কে বিনোদপুর বাজারের সামনে দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। রাত সাড়ে ৮টার দিকে বিনোদপুর বাজারে আসেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সিটি মেয়র এএইচএম খাইরুজ্জামান লিটন। তিনি দুই পক্ষকেই শান্ত হওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। থেমে থেমে সংঘর্ষ চলছিলই।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আসার পর রাত ৯টা ৫ মিনিটে পুলিশ প্রথম অ্যাকশন শুরু করে। পুলিশ লাঠিপেটা ও ধাওয়া দিয়ে বিনোদপুর বাজার থেকে ব্যবসায়ীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
রাজশাহীর নগর পুলিশের কুইক রেসপন্স টিম এবং র্যাবের সদস্যরা এ অভিযানে অংশ নেন। দাঙ্গা দমনের কাজে ব্যবহৃত পুলিশের একটি এপিসি গাড়ি দিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে দেখা যায়। এরপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তবে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি এসে দোকানপাটগুলোর আগুন নিভিয়েছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় বিনোদপুর গেটে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবস্থানস্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় রাত সাড়ে ১০টায় পরিস্থিতি আরও উত্তাল হয়ে ওঠে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বাইরে বের হয়ে মহাসড়কে চলে আসেন।
তারা আবারও দোকানপাটে আগুন দিতে শুরু করেন। এ সময় পুলিশ টিয়ার সেল ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করে। এখন আবার ক্যাম্পাসের ভেতরে শিক্ষার্থী এবং বাইরে মহাসড়কের উপরে পুলিশ অবস্থান করছে। বাজারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন ব্যবসায়ীরাও। বিরাজ করছে তুমুল উত্তেজনা।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বাইরে এসে সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে ব্যবসায়ীরা শিক্ষার্থীদের রক্ত ঝরাতে সাহস পেয়েছে। এই ঘটনায় তাঁরা বিচার চান।
ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে বিনোদপুর বাজার বণিক সমিতির উপদেষ্টা আবদুল আজিজ বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা প্রথমে ইমরান নামের এক ব্যবসায়ীর দোকানে ঢুকিয়ে বাস চালক ও হেলপারকে মারধর করছিল। তাদের রক্ষা করার চেষ্টা করায় তারা ব্যবসায়ীদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছে। এই ঘটনায় ব্যবসায়ীদের কোনো দোষ নেই।’
ঘটনার ব্যাপারে রাতে পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ বক্তব্য দেননি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহউপাচার্য অধ্যাপক সুলতান উল ইসলাম বলেন, ‘এ পর্যন্ত শিক্ষার্থী আহতের সংখ্যা দুই শ ছাড়িয়ে গেছে।’
ঘটনার ৩ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও কেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন এসব ব্যাখ্যা করার সময় নয়, কাজ করার সময়। আমাদের কাজ করতে দিন।’
এ ঘটনায় আগামীকাল রোববার ও সোমবার সব ধরনের ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঘটনার প্রায় ৪ ঘণ্টা পর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার। এ সময় তিনি মাইকে এ ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা দেওয়ার পর তোপের মুখে পড়েন তিনি। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস বন্ধের প্রতিবাদ জানান।
উপাচার্য মাইকে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমাদের প্রতি অনুরোধ, হলে ফিরে যাও। তোমাদের জন্য প্রশাসন সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। রুমে যাও তোমরা। এ ঘটনায় প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
The post রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রণক্ষেত্র: ৭ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন first appeared on Barishal Times | বরিশালটাইমস.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন