বরিশালের টাইমস, জাতীয়, রাজনীতি, অর্থনীতি, সারা বাংলা, আন্তর্জাতিক, খেলাধুলা, চাকরি, বিনোদন, সাতসতেরো, ক্যাম্পাস, অন্যান্য

Breaking

মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৫

বাংলাদেশে দালালতন্ত্র: জনমত বনাম ভূ-রাজনীতি

বাংলাদেশের রাজনীতি এবং শাসনব্যবস্থা নিয়ে প্রায়শই একটি আলোচিত ও বিতর্কিত অভিযোগ শোনা যায়, আর তা হলো—দেশ কখনোই জনগণের সরাসরি ভোটে বা জনমতের ভিত্তিতে চলেনি। বরং, এর পেছনে কাজ করেছে এবং এখনও করছে এক অদৃশ্য দালালতন্ত্র, যা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট বিদেশী শক্তির স্বার্থ রক্ষা করে। অভিযোগটি হলো, একসময় এই দালালরা ছিল ভারতীয় দালাল, আর বর্তমানে তারা আমেরিকান দালাল হিসেবে পরিচিত। এই ধারণাটি দেশের রাজনৈতিক ধারা বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণ তৈরি করে।

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও শক্তির হাতবদল

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশটির পররাষ্ট্রনীতি এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির প্রভাব ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট।

 * স্বাধীনতার পরে এবং ভারতীয় প্রভাব (দালালতন্ত্র): বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সরাসরি সমর্থন এবং ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্বাধীনতার পর পরই দেশের রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে এবং সামরিক নীতিতে ভারতের একটি ব্যাপক প্রভাব ছিল বলে অনেকে মনে করেন। অভিযোগকারীরা এই সময়টিকে 'ভারতীয় দালালদের' শাসনের যুগ বলে অভিহিত করেন। তাঁদের মতে, সেসময়কার সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হতো দিল্লির স্বার্থ রক্ষা করার জন্য, জনগণের চাওয়া বা জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে। এই ধারণাটি মূলত সেইসব রাজনৈতিক গোষ্ঠী এবং সমালোচকদের মধ্যে প্রচলিত, যারা মনে করেন ভারত বাংলাদেশের উপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করেছিল।

 * বর্তমান প্রেক্ষাপট ও আমেরিকান প্রভাব (দালালতন্ত্র): সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে, অভিযোগের তীর ঘুরেছে আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের দিকে। এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ ক্রমশ পশ্চিমা দেশগুলোর বিশেষত আমেরিকার মনোযোগের কেন্দ্রে এসেছে। অভিযোগকারীরা বলছেন, এখন দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো আসলে 'আমেরিকান দালাল' হিসেবে কাজ করছে। তাদের মতে, অর্থনৈতিক সুবিধা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বা নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর বিনিময়ে তারা এমন নীতি গ্রহণ করছে যা আমেরিকার কৌশলগত বা অর্থনৈতিক স্বার্থ পূরণ করে। দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার বা নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা চাপকে অনেকে এই দালালতন্ত্রেরই প্রকাশ হিসেবে দেখেন।

জনগণের ভোট বনাম বাস্তব ক্ষমতা

এই সমালোচনার মূল ভিত্তি হলো এই ধারণা যে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রক্রিয়াটি শুধুমাত্র একটি বাহ্যিক আবরণ। জনগণের ভোট বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা এখানে চূড়ান্ত নয়।

 * নির্বাচন এবং এর বৈধতা: এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীরা মনে করেন যে দেশের নির্বাচনগুলো প্রায়শই প্রশ্নবিদ্ধ এবং স্বচ্ছ নয়। ফলস্বরূপ, যারা ক্ষমতায় আসেন তারা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আসেন না, বরং বিদেশী প্রভুদের সন্তুষ্ট করে ক্ষমতা ধরে রাখেন। ক্ষমতা পরিবর্তন হয় দেশীয় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে নয়, বরং আন্তর্জাতিক শক্তির ইশারায় বা সমঝোতার মাধ্যমে।

 * ক্ষমতার আসল কেন্দ্র: অভিযোগটি এটাই তুলে ধরে যে, আসল ক্ষমতা থাকে একটি ছোট অভিজাত গোষ্ঠীর হাতে—যারা বিদেশী দূতাবাস, বহুজাতিক সংস্থা এবং প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক লবিদের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত। তারা নিজেদের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত সুবিধা এবং বিদেশী পৃষ্ঠপোষকদের স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেন।


'বাংলাদেশ চালায় সব সময় দালালরা'—এই বক্তব্যটি একটি গভীর হতাশা এবং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এই ধারণা দেশের নাগরিকদের মধ্যে প্রচলিত এই বিশ্বাসকেই প্রতিফলিত করে যে, তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং নির্বাচনী রায় দেশের প্রকৃত ভাগ্য নির্ধারণ করে না। বরং দেশের নীতি এবং ক্ষমতার পালাবদল নিয়ন্ত্রিত হয় ভূ-রাজনৈতিক দাবা খেলার চাল হিসেবে। ভারতীয় বা আমেরিকান দালাল যেই হোক না কেন, এই অভিযোগ দেশের সার্বভৌমত্ব এবং জনগণের ক্ষমতা নিয়ে একটি মৌলিক প্রশ্ন তুলে ধরে। এই ধারণা যতদিন থাকবে, ততদিন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই থেকে যাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Pages