এডুহাইভ: উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প
অনিক আহমেদশিক্ষা ব্যবস্থায় অঞ্চলভেদে বিভিন্ন কারণে মানের তারতম্য লক্ষ্যণীয়। সাধারণত গ্রাম এবং শহর, রাজধানী এবং তার বাইরের অঞ্চলে এসব তারতম্য বেশি দেখা যায়। এক অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কারণে অন্য অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের থেকে পিছিয়ে পড়ে। এসব সমস্যার সমাধানে গত বছরের ৩১ আগষ্ট ‘এডুহাইভ’ নামে একটি অ্যাপ উদ্ভাবন করেছেন কয়েকজন তরুণ উদ্যোক্তা। এডুহাইভের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একই সাথে দেশের স্বনামধন্য শিক্ষক ও শিক্ষা সহায়ক প্রতিষ্ঠানসমূহের সার্ভিস পাবে। এর ফলে শিক্ষার ক্ষেত্রে সকল বৈষম্য দূর হবে বলে আশা করছেন এডুহাইভের সহ প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মো. নাজমুল হক সরকার বুলবুল। সম্প্রতি তিনি রাইজিংবিডিকে এডুহাইভ এবং তার নিজের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প শুনিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অনিক আহমেদ।
রাইজিংবিডি: আপনার শিক্ষা জীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
নাজমুল হক সরকার বুলবুল: জন্ম এবং বেড়ে ওঠা লালমনিরহাটে। মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি লালমনিরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। বাবা ঐ প্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। মা গৃহিনী। চার ভাই ও এক বোন। ২০০৩ সালে রাজধানীর সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করি।
রাইজিংবিডি: ছোটবেলায় কী হতে চাইতেন?
নাজমুল: অনেক কিছুই হবো বলে ভাবতাম। তবে সেই ভাবনাগুলো স্থায়ী ছিল না। বাবা শিক্ষকতা করতেন, সেই সুবাদে শিক্ষকতার প্রতি একটা আলাদা টান ছিল। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় টিউশনি করতাম। এক সময় ইচ্ছা ছিল বুয়েটে পড়ে বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো। কিন্তু সেটা না হওয়ার কারণে ঢাবিতে পরিসংখ্যানে পড়াকালীন ব্যাংকার হতে চাইতাম।
রাইজিংবিডি: উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প জানতে চাই
নাজমুল: ঢাবিতে অধ্যয়নকালীন এবং পড়া শেষে চাকরিতে প্রবেশের পরেও অবসরে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারগুলোতে লম্বা সময় ক্লাস নিতাম। এ সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকাতে আগত শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যাগুলো কাছ থেকে দেখার সুযোগ হতো। ঢাকায় আসার পর শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা, নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়া, জ্যামে দীর্ঘসময় নষ্ট হওয়া, মেয়েদের নিরাপত্তা, খরচের ব্যাপারগুলো লক্ষ্য করতাম। শিক্ষার্থীদের এসব বিষয়গুলো সমন্বয় করতে অনেক সময় চলে যেত। অনেক সময় দেখা যায়, তারা একভাবে পড়ালেখা করে এসেছে, কিন্তু পরে বুঝতে পারে যে সে বেশ পিছিয়ে আছে। এসব ব্যাপারে তাদের মাঝে এক ধরনের হতাশা লক্ষ্য করতাম এবং অনেকেই প্রতিযোগিতা থেকে ঝরে পড়তো। এই বিষয়গুলো আমি এবং আমার কোচিংয়ের ২ জন সহকর্মী (রবিউল ইসলাম ও মেহফুজ জহির শিশির) ভালোভাবে উপলব্ধি করি। তখন আমরা চিন্তা করি, এই শিক্ষার্থীগুলো যে অবস্থানে আছে সেখানে থেকেই যদি আমরা কোনোভাবে এদের কোয়ালিটি এডুকেশন, পরীক্ষার সঠিক প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে পারি তাহলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশাল একটা পরিবর্তন আসবে। এই চিন্তাধারা থেকেই মূলত শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যতিক্রমধর্মী কিছু একটা করার কথা ভাবি।
রাইজিংবিডি: কেন উদ্যোক্তা হলেন?
নাজমুল: ঢাবিতে পড়াকালীন সময়েই নিজে থেকে কিছু একটা করার পরিকল্পনা ছিল। ২০১২ সালে আমার প্রথম জব নিউজক্রেড ডটকমে কোয়ালিটি এসুরেন্স ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগদান করি। এখানে সাড়ে চার বছর কাজ করি। এরপর টেলিনর হেলথে টেকনোলজি কোয়ালিটি ম্যানেজার হিসেবে জয়েন করি এবং হেড অব কোয়ালিটি অ্যান্ড প্রোগ্রাম হিসেবে শেষ করি। এই দুই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার ফলে স্টার্টাপ বিষয়ে আমার বেশ ভালো ধারণা হয়। কারণ, টেলিনরে আমি শুরু থেকেই কাজ করেছি আর নিউজক্রেড তো একটা সফল স্টার্টাপ। এভাবে আমার বিজনেস আইডিয়া জন্মাতে থাকে। এরপর অল্প সময়ের জন্য সেবাতে (Sheba.xyz) সিইও এর কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করি। সেবার সিইও আদনান ভাইয়ের থেকে আমি অল্প সময়ে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা শিখতে পারি, তা হলো একজন উদ্যোক্তার চিন্তা-ভাবনা ও দায়িত্ববোধ সম্পর্কে। আমি মনে করি, একটা স্টার্টাপ দিতে গেলে ফাইনাল একটা পুশ লাগে, যেটা আমি সেবা থেকে পাই। এরপর ২০১৮ সালের ৫ অক্টোবর আমার জন্মদিনে আমরা ৩ জন সহপ্রতিষ্ঠাতা শিক্ষার্থীদের পূর্বে উল্লেখকৃত সমস্যাগুলো সমাধানে একটা কিছু করার জন্য আলোচনা করি। এর ফলাফল হলো আজকের ‘এডুহাইভ’।
রাইজিংবিডি: এডুহাইভ সম্পর্কে জানতে চাই।
নাজমুল: এডুহাইভ হচ্ছে মূলত অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা বিষয়ক একটি অ্যাপ। যা শিক্ষার ডিজিটালাইজেশনে কাজ করে। এখানে শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা এবং বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারবে। শিক্ষার্থীরা স্বল্প খরচে সাবস্কিপশনের মাধ্যমে ঘরে বসে দেশের স্বনামধন্য শিক্ষক ও শিক্ষা সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ভিত্তিক কোর্সের একাধিক লেকচার, শিক্ষা সহায়িকা বিষয়ে কন্টেন্ট পাবে। অ্যাপটির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে পরীক্ষা দিতে পারবে, সাথে সাথে ফলাফল পাবে এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে তার অবস্থান জানতে পারবে। সম্প্রতি, আমরা 'এডুহাইভ স্কলারস ২০২০' এর ব্যবস্থা করেছি, যার মাধ্যমে চলতি শিক্ষাবর্ষের বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ টাকার শিক্ষাবৃত্তি লাভ করবে।
রাইজিংবিডি: শিক্ষার্থীরা কেন এডুহাইভকে বেছে নিবে?
নাজমুল: আমাদেরও একটা ফ্রি অপশন আছে। আমাদের প্যাকেজটা মূলত দুইটা ভাগে বিভক্ত, বেসিক ও অ্যাডভান্সড। বেসিকের মাধ্যমে কোনো খরচ ছাড়াই বিগত বছরের বিভিন্ন বোর্ডের প্রশ্নগুলো অনুশীলন করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীরা যে পেমেন্ট করছে সেটা কিন্তু এককালীন। এক সাবস্ক্রিপশনেই সবকিছু পাচ্ছে। এমন নয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তুতির জন্য তাকে নির্দিষ্ট কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা সহায়ক প্রতিষ্ঠানে আলাদাভাবে সাবস্কিপশন করতে হচ্ছে। এডুহাইভে শিক্ষার্থীরা একই বিষয়ে অনেক শিক্ষক ও শিক্ষা সহায়ক প্রতিষ্ঠানের সব মডেল টেস্ট এক অ্যাপেই দিতে পারছে এবং কন্টেন্ট প্রদানকারী শিক্ষক ও শিক্ষাসহায়ক প্রতিষ্ঠানের ভালো গ্রহণযোগ্যতা আছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে কমপ্লিটনেস অর্থাৎ আমরা যদি একটা সিলেবাস ধরি, তাহলে ঐ সিলেবাসের এটুজেড প্রিপারেশনের জন্য কাজ করি। এডুহাইভের দেয়া এই সুবিধাটা নিতে পারলে শিক্ষার্থীর প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি থাকবে না।
রাইজিংবিডি: বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আপনার পরিকল্পনা?
নাজমুল: আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আমাদের শিক্ষাকে প্রসারের পরিকল্পনা আছে। তবে সেটার জন্য বিদেশি বিভিন্ন ভাষায় ক্লাস নেয়া, সংশ্লিষ্ট দেশের সিলেবাস অনুসরণের প্রয়োজন আছে। আমরা ধীরে ধীরে সেদিকে আগাবো। এর আগে আমাদের দেশের অষ্টম শ্রেণি থেকে শুরু করে বিসিএস পর্যন্ত প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থীর মাঝে এটা পৌঁছে দিতে চাই। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বিদেশে থেকে অনেক শিক্ষার্থী আমদের দেশীয় সিলেবাসে পরীক্ষা দিয়ে থাকে। আমাদের এই অ্যাপের মাধ্যমে সেসব শিক্ষার্থীরা এখন তাদের নিজ অবস্থান থেকেই সঠিক প্রস্তুতি নিতে পারবে।
রাইজিংবিডি: কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?
নাজমুল: শুরু থেকেই আমাদের বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রথমত যে বিষয়টা ছিল, সেটা বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিক্ষক এবং শিক্ষা সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একই প্ল্যাটফর্মে আনা। যেহেতু তারা শিক্ষার্থীদের পড়ান এবং এর সাথে অর্থনৈতিক একটা ব্যাপার আছে, সুতরাং তারা আমাদের সাথে আসতে চাইবেন কি না এটা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল।
রাইজিংবিডি: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
নাজমুল: আমরা মনে করি, একজন শিক্ষার্থীর অনেক ধরনের সার্ভিস প্রয়োজন। তার পড়ালেখার জন্য আরো যা কিছু প্রয়োজনীয় সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি, ধাপে ধাপে আমরা এগুলো তাদেরকে দিতে সক্ষম হবো। এছাড়া শিক্ষার বাইরেও সফলতার জন্য অনেক উপাদান লাগে। এগুলো সময়ের সাথে সাথে এডুহাইভের মাধ্যমে যুক্ত করে দিব। মোটকথা, একজন শিক্ষার্থীর সব প্রয়োজনীয়তা এডুহাইভের মাধ্যমে নিশ্চিতকরণের জন্য কাজ করে যাবো।
ঢাকা/অনিক/সাইফ
from Risingbd Bangla News https://ift.tt/2MZwxW8
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন