অনির্বাণ ঘোষ ■ হিলিসবে তখন পাটে গিয়েছে সূর্য। ঈশ্বরের কাছে বাড়ির লোক প্রার্থনা করছিলেন, পর দিন ভোরের আলো ফোটার আগে যেন কিছু না হয়। ভারতীয় হলেও সাকিন যে তাঁদের কাঁটাতারের ও পারে! আর নিকটবর্তী হাসপাতাল রায়নগর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র কাঁটাতারের এ পারে। বাড়িতে আসন্নপ্রসবা বধূ। কিন্তু দেশের মূল ভূখণ্ডে ঢোকার ফটকই সন্ধ্যা ৬টায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে! খুলবে আবার পর দিন সকাল ৬টায়।বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও বাস্তব। এই ছবি দক্ষিণ দিনাজপুরের নীচা গোবিন্দপুর গ্রামের। দেশের আর পাঁচটা সীমান্তবর্তী গ্রামের সঙ্গে ঢের ফারাক এই তল্লাটের। কেননা, হিলির ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের এই গ্রামের অবস্থান কাঁটাতারের এ পারে নয়, ও পারে। অথচ বাংলাদেশও নয়, খাস ভারতে। ফলে আসন্নপ্রসবা বধূকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল পরিবার। কিন্তু বিধি বাম! রাত ১১টা নাগাদ প্রসব বেদনায় ছটফট করতে শুরু করলেন পম্পি সরকার। আত্মীয়-প্রতিবেশীরা ভ্যান-রিকশায় শুইয়ে সীমান্তের বেড়া পর্যন্ত নিয়েও এসেছিলেন তাঁকে। কিন্তু সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে অ্যাম্বুল্যান্স আনাতে আনাতেই প্রসব বেদনা এমন চরমে পৌঁছায় যে কোনও রকমে প্রসূতিকে বাড়িতেই ফেরত নিয়ে যেতে বাধ্য হন পরিজন। সেখানেই সন্তান প্রসব করেন পম্পি।একা পম্পি নন। মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে সরকারি হাসপাতাল থাকলেও তা কাঁটাতারের এ পারে হওয়ায় পম্পির মতো দুরবস্থায় পড়তে হয় অনেক প্রসূতিতে। তাঁদের সকলের পরিণতি সব সময়ে ভালোও হয় না। কিন্তু উপায় কী! উঁচা গোবিন্দপুর, নীচা গোবিন্দপুর, জামালপুর, শ্রীকৃষ্ণপুর, উজাল, হাঁড়িপুকুর, গয়েশপুর (আংশিক), ঘুষুড়িয়া, গোঁসাইপুরের মতো গ্রামগুলিতে আপৎকালীন পরিষেবার কোনও ব্যবস্থাই নেই।অথচ বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত এই সব গ্রামে হাজার দশেক মানুষের বাস। ভারতীয় ভূখণ্ড হওয়া সত্ত্বেও দু’পারের মধ্যে জীবন যাপনের নির্ণায়ক ভূমিকায় দাঁড়িয়ে কাঁটাতারের বেড়া আর সীমান্তরক্ষী বাহিনী। সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা, এই ১২ ঘণ্টায় কাঁটাতারের বন্ধ ফটকটা সচিত্র পরিচয়পত্র আর সন্তোষজনক কারণ দর্শানো ছাড়া খোলা হয় না। কোনও জরুরি পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে নিতান্তই অসহায় বোধ করেন এই অঞ্চলের হাজার দশেক মানুষ। ভোট এলেও তাঁদের জীবন যে শোধরাবে, অতীত অভিতজ্ঞতার কারণেই এমন আশা এখন আর তেমন জাগে না তাঁদের মনে।তাই, ভোটের মরসুমে দেওয়াল লিখন-ফ্লেক্স-ঝান্ডা-ব্যানার-হোর্ডিংয়ে গ্রামকে গ্রাম রঙিন হয়ে গেলেও ভোট নিয়ে এই গ্রামবাসীদের অধিকাংশই উদাসীন। জয়ী প্রার্থীর আলাদা গুরুত্বও নেই তাঁদের কাছে। সেই জন্যই হয়তো কেউ প্রচারে আসেন না এখানে। ব্যতিক্রম, তৃণমূল প্রার্থী তথা বিদায়ী সাংসদ অর্পিতা ঘোষ। তিনি এলেন বটে প্রচারে, কিন্তু প্রচারের একেবারে শেষ দিন রবিবার।উজালের রবিবুল ইসলাম বলছিলেন, ‘ভোটপ্রচারে দলীয় কর্মীদের ভিড় হলেও তাতে উন্মাদনা চোখে পড়ে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের যে বেঁধে দেওয়া সময় সূচি বদলের সম্ভাবনা প্রায় নেই।’ গোবিন্দপুরের পার্থ মণ্ডল জানান, তাঁদের ওই এলাকায় একমাত্র বুথ রয়েছে জামালপুরে। সেখানে প্রায় ১৪০০ ভোটার। আর বাকিরা সকলে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে ভোট দিতে আসেন এ পারে। কিন্তু যে কোনও সাধারণ পরিষেবার জন্য হিলি শহরে এসে কাজ করার জন্য বরাদ্দ সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা।হিলির আরএমএ হাইস্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সাগর ঘোষের কথায়, ‘উঁচা গোবিন্দপুরে থাকি। ৪টের পর স্কুল ছুটি হয়। সপ্তাহে তিন-চার দিন টিউশন পড়া থাকে তার পর। যতক্ষণে সব মেটে, ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা ৬টা পেরিয়ে যায়। ফলে বাড়ি ফিরতে পারি না। থেকে যেতে হয় বন্ধুর বাড়িতে।’ ওই ছাত্রের একটাই আর্জি--- গেট খুলে রাখার সময়সীমা আরও বাড়ানো হোক। তাঁর পড়শি অভিজিৎ মোহান্তর কথায়, ‘আমরা সাধ করে এই এলাকায় থাকতে আসিনি। কাঁটাতারও আমরা লাগাইনি। অথচ বাড়ি থেকে কাজে যেতে হলে কিংবা দিনের শেষে নিজের বাসায় ফিরতে হলেও আমাদের পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। আমরা তো নিজভূমেই পরবাসী!’
from Eisamay http://bit.ly/2UsBmsc
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
Author Details
I am an Executive Engineer at University of Barishal. I am also a professional web developer and Technical Support Engineer.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন