বরিশাল বিভাগে খাসজমি এক হাজার ১১ দশমিক ৬১৭৩ একর।
অনলাইন ডেস্ক:
দেশে আবাদযোগ্য কৃষি ও অকৃষি লাখ লাখ একর সরকারি জমির (খাস) ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। জেলা-উপজেলায় এমনকি মহানগরীগুলোতে প্রভাবশালীরা ওইসব সম্পত্তি ভোগ করছেন।
অথচ উপকূলীয় জেলার বেড়িবাঁধ ও মহানগরীর বস্তিতে লাখ লাখ ভূমিহীন মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ ও ভারসাম্য। সরকারি জমি অবৈধভাবে দখলে রাখার ক্ষেত্রে সমাজপতিদের সাথে ভূমি প্রশাসনের উঁচু-নিচু তলার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নিবিড় সম্পৃক্ততা রয়েছে।
এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন, খাসজমি বন্দোবস্তের নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। তা অনুসরণ করে বন্দোবস্ত দেয়া হচ্ছে। তবে খাসজমি ব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রণ, উদ্ধার, রক্ষণাবেক্ষণ এবং তা নিয়ে নতুন করে কিছু ভাবার কাজটি আমলারা করতে পারেন না। সরকারি সিদ্ধান্ত ও সদিচ্ছা না থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কী করতে পারেন। খাসজমি নিয়ন্ত্রণে না থাকায় সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে বলে স্বীকার করেন তারা।
অপরদিকে, এক শ্রেণির প্রভাবশালী সরকারি জমি পুঁজি করে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নজরের বাইরেও নয়। প্রতি মাসেই বিভাগীয় কমিশনারদের মাসিক সমন্বয় সভায় জবরদখলে থাকা খাসজমি উদ্ধারের জন্য তাগিদ দেয়া হচ্ছে।
গত জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ডিসিদের প্রস্তাব ছিল— বেহাত হওয়া অনাবাদি খাস সম্পত্তি উদ্ধারে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। বর্তমানে অর্থ সংকটের কারণে বেহাত হওয়া সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার করা সম্ভব হয় না।
সাবেক ভূমি সচিব মাকছুদুর রহমান পাটোয়ারি আমার সংবাদকে বলেন, ‘খাসজমি উদ্ধার ও ব্যবস্থাপনায় একটি জাতীয় কমিটি রয়েছে। প্রতি মাসেই কমিটির মিটিং হয়। কোন শহরে কত একর খাসজমি জবরদখলে রয়েছে তা নিরূপণ করা হয়। ওই জমির মূল্য কত তা পর্যালোচনা করা হয়। উদ্ধার করার জন্য তাগিদ দেয়া হয়। যারা উদ্ধারে নেতৃত্ব দেন তাদের চিঠি ও মোবাইলে সরাসরি ধন্যবাদ দেয়া হয়। তারপরও দুষ্ট লোকের তো অভাব নেই। তহসিল পর্যায়ে কিছু অনিয়ম হয়। আশা করি তারাও এক সময় ঠিক হয়ে যাবে। উদ্ধার হবে খাসজমি সুফল পাবে জনগণ।’
সরকারি খাসজমি প্রতিনিয়ত দখল, উচ্ছেদ ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। উচ্ছেদে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়। সে ক্ষেত্রে মামলা পরিচালনা, মামলায় জেতার পর দখল এবং সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পুরোনো সীমানা প্রাচীর নতুন করে নির্মাণের প্রয়োজন হয়। এসব কাজে পর্যাপ্ত অর্থের দরকার পড়ে। বিষয়টি বিচেনার জন্য ডিসিরা সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছেন। সরকারি খাসজমি উদ্ধার এবং দখল বজায়ে রাখতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করেছেন তারা। ডিসিদের প্রস্তাব ছিল— তামাদি আইন বাতিল করতে হবে। তামাদি আইন বিদ্যমান থাকায় এবং আপিল নামঞ্জুর হওয়ায় বিপুল পরিমাণ সরকারি সম্পত্তি বেহাত হচ্ছে। সরকারি স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে কৃষি খাসজমির পরিমাণ ১৭ লাখ ১২ হাজার ৩৩ দশমিক ৯০ একর। তার মধ্যে তিন লাখ ২২ হাজার ৫৫ একর জমি বন্দোবস্তযোগ্য। বাকি ১৩ লাখ ৮৯ হাজার ৪৭৯ দশমিক ৪ একর জমি বন্দোবস্তযোগ্য নয়। এই পরিসংখ্যান কতটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়েই প্রশ্ন রয়ে গেছে। ১৩ লাখ একর জমি চাষযোগ্য নয় কেন। বন্দোবস্ত অযোগ্য জমি হচ্ছে— হালট, বিল, বাওর, জঙ্গল, নদী-নালা শ্রেণিভুক্ত।
প্রশ্ন হচ্ছে, ওই শ্রেণির জমি কৃষি জমি হিসেবে চিহ্নিত করা হবে কেন? ওই ধরনের জমির জন্য তো আলাদা শ্রেণি করা যায়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রকৃত কৃষি খাসজমির চিত্র পাওয়া যাবে না। কারণ এর সাথে ভূমি প্রশাসনের মাঠপর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের সাথে জবরদখলকারীদের নিবিড় ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। উপরির একটা বড় ক্ষেত্র হচ্ছে কৃষি খাসজমি। সভায় জবর দখলের কথাও উঠেছে। প্রশ্ন হচ্ছে কারা কী ভাবে জবরদখল করেন তার কোনো ব্যাখ্যা নেই কেন? প্রকৃত কৃষক খাসজমি বন্দোবস্ত পায় না। কৃষকের নামে প্রভাবশালীরা কৌশলে বন্দোবস্ত নিয়ে তারাই ভোগ করছেন। অনেকে মনে করেন, স্থায়ী বন্দোবস্ত না দিয়ে একসনা বন্দোবস্ত দিলে সুবিচার হবে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, অকৃষি খাসজমির পরিমাণ ২৩ লাখ ৫৫ হাজার ৯১ দশমিক ২৯ একর। সব মিলিয়ে কৃষি ও অকৃষি খাসজমির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ২৬ লাখ একর। বন্দোবস্তযোগ্য অকৃষি খাসজমির পরিমান এক লাখ সাত হাজার ৯৩৩ একর। সব মিলিয়ে বন্দোবস্তযোগ কৃষি ও অকৃষি খাসজমির পরিমাণ প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ একর। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার অভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষকে যেমন ভূমিহীন করে রাখা হয়েছে, তেমনিভাবে সরকারি সম্পত্তি ভোগের একক সুযোগ পাওয়ায় এক শ্রেণির মানুষ রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে।
সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার একর অকৃষি খাসজমি প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ সব মূল্যবান সরকারি সম্পত্তি নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই সরকারি কর্মকর্তাদের যথাযথ ভূমিকার অভাবে মামলায় সরকার হেরে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ভূমি প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তরা সরকারের চেয়ে প্রভাবশালীদের স্বার্থ দেখছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, সরকারি খাসজমি অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা বছরের পর বছর ধরে ভোগ করছেন। চরাঞ্চলের আবাদযোগ্য ধানি জমিও তারা ভোগ করছেন। স্থানীয় সহকারী কমিশনার (ভূমি), ইউএনও, এডিসিল্যান্ড এবং ডিসিরা দখলদারদের সহযোগী। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, তারাই খাসজমি ভোগদখলে রাখে। দেখা গেছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ভূমি প্রশাসনের উল্লিখিত ব্যক্তিরা ভূমিহীন কৃষকের কাছ থেকে প্রতি বছর একর প্রতি পাঁচ-সাত হাজার টাকা নিয়ে তাকে জমি চাষাবাদ করতে চিচ্ছেন। ওই কৃষকের কাছ থেকে টাকা আদায়ের দায়িত্বে থাকেন ক্ষমতাসীন দলের কোনো ক্যাডার কিংবা স্থানীয় ইউপি কিংবা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান।
ওই টাকার ভাগ এসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি ল্যান্ড এবং ডিসিরাও পেয়ে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে এ টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটির ঘটনাও ঘটেছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে অনুষ্ঠিত বিভাগীয় কমিশনারদের সাথে সমন্বয় সভায় কমিশনাররা জানান, অনেক এসিল্যান্ড কৃষি খাসজমি ডিসিআরের বিপরীতে একসনা বন্দোবস্তে দিয়ে আদায় হওয়া টাকা সরকারি খাতে জমা দিচ্ছেন না। তারা ডিসিআরের মুড়ি ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের কাছে জমা দিচ্ছেন না।
ভূমি সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, ডিসিআর বাবদ আদায় হওয়া অর্থ এতই সামন্য যা নিয়ে কোনো অভিযোগই হতে পারে না। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, চরের জমি বন্দোবস্ত দিয়ে এসিল্যান্ডরা এডিসি ল্যান্ড, ডিসিকে ভাগ না দেয়ায় তারা বিভাগীয় কমিশনারদের দিয়ে মন্ত্রণালয়ের সমম্বয় সভায় মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করিয়েছেন।
সূত্র জানায়, ভূমি মন্ত্রণালয় খাসজমির যে পরিসংখ্যান তৈরি করেছে তা সঠিক নয়। কারণ বছরের পর বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে নদীগর্ভে জেগে ওঠা চরের জমি জরিপের আওতায় আনা হয়নি। বরিশালে বিভাগে গত ২০ বছর ধরে জরিপ চলছেই। এখনো শেষ হয়নি। তা হলে তারা জমির প্রকৃত হিসাব পেলেন কোথায়। মহানগরীগুলোতেও ১৯৯৮ সালে যে জরিপ করা হয়েছিল তার পর থেকে আর কোনো জরিপ হয়নি। ঢাকার পরিধি রাতারাতি যেভাবে বাড়ছে তাতে ঢাকায় অকৃষি খাসজমির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কথা। সুতরাং মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা খাসজমির পরিমাণ নিয়ে বিভ্রান্তি থাকাই স্বাভাবিক।
বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে কৃষি খাসজমি রয়েছে এক লাখ ৫২ হাজার ৪৪৩ দশমিক ৮৯ একর, চট্টগ্রাম বিভাগে আট লাখ ৪০ হাজার ৬২৭ দশমিক ৪০৬ একর, রাজশাহী বিভাগে এক লাখ ১১ হাজার ৩৪৬ দশমিক ৭৫৫৬ একর, খুলনা বিভাগে ৯৪ হাজার ৫০১ দশমিক ৩৫৭৬ একর, ময়মনসিংহ বিভাগে এক লাখ ২১ হাজার ৬৯২ দশমিক ৫৯ একর, রংপুর বিভাগে এক লাখ ৩৮ হাজার ১৭৩ দশমিক ৮০ একর, সিলেট বিভাগে এক লাখ ৫৮ হাজার ২৯৯ দশমিক ৯৫ একর এবং বরিশাল বিভাগে ৯৪ হাজার ৯৪৮ দশমিক ১৪৭৫ একর।
অপরদিকে ঢাকা বিভাগে অকৃষি খাসজমির পরিমাণ হচ্ছে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৬৪ দশমিক শূন্য পাঁচ একর, চট্টগ্রাম বিভাগে ১২ লাখ ৮৬ হাজার ৯৫১ একর, রাজশাহী বিভাগে এক লাখ ৬৬ হাজার ৫৯০ দশমিক ৫৬৮৩ একর, খুলনা বিভাগে এক লাখ ৩২ হাজার ৭৫৭ দশমিক শূন্য ৯৪৪ একর, ময়মনসিংহ বিভাগে ৯৫ হাজার ৫৬৮ দশমিক ৩৬ একর, রংপুর বিভাগে এক লাখ ১৮ হাজার ৩৩০ দশমিক ৯০ একর, সিলেট বিভাগে দুই লাখ ১৬ হাজার ৮১৬ দশমিক ৯৫৬ একর এবং বরিশাল বিভাগে এক হাজার ১১ দশমিক ৬১৭৩ একর।
The post সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই খাসজমিতে appeared first on BarishalNews24.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন