সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর, তিনি মানুষকে গোনাহ মুক্তির জন্য কিছু সময় নির্ধারিত করেছেন। যেন তারা ওই সময়ে আল্লাহকে প্রাণভরে ডেকে, নিজেদের পাপগুলো মাফ করিয়ে তার প্রিয়পাত্র হতে পারে। এসব সময়ের মধ্যে শবেবরাত অন্যতম। শবেবরাত শাবান মাসের পঞ্চদশ রাতে পালিত হয়। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিমান্বিত এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা ১৫ শাবানের রাত বলে অভিহিত করেছেন।
ফার্সি ‘শব’ অর্থ রাত, আর বারাত অর্থ মুক্তি, নিষ্কৃতি, পবিত্রতা ইত্যাদি। শবেবরাতের শাব্দিক অর্থ- মুক্তি, নিষ্কৃতির রাত। এ রাতে যেহেতু মহান আল্লাহ পাপী বান্দাদের ক্ষমা করেন, গোনাহ থেকে নিষ্কৃতি এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন- তাই এ রাতকে শবেবরাত বা মুক্তির রাত বলা হয়।
কোনো মানুষ যদি এ রাতে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে, তাহলে আল্লাহ তার পাপরাশি ক্ষমা করেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘হামিম, এ স্পষ্ট কিতাবের শপথ! নিশ্চয়ই আমি তা বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে বন্টন করে দেওয়া হয় প্রত্যেক হিকমতের কাজ।’ -সুরা আদ দোখান : ১-৪
তাফসিরে জালালাইনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি তা বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। আর বরকতময় রাত হলো- লাইলাতুল কদর (কদরের রাত) অথবা লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান (শবেবরাত)। কেননা এই রাতে উম্মুল কিতাব (কোরআন মাজিদ) সপ্তম আসমান থেকে দুনিয়ার আসমানে (প্রথম আসমান) নাজিল হয়েছে। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী।’ -তাফসিরে জালালাইন : ৪১০
তাফসিরে বাগভিতে বর্ণিত আছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ শবেবরাতে সব বিষয়ের চূড়ান্ত ফায়সালা করেন এবং শবেকদরের রাতে তা সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববান ফেরেশতাদের কাছে ন্যস্ত করেন। -তাফসিরে বাগভি : ৭/২২৮
আরবি শাবান মাস বিশেষ মর্যাদার। এ মাসে হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর কেবলা পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে। বায়তুল মোকাদ্দাসের পরিবর্তে কাবা শরিফের দিকে মুসলমানদের কেবলা নির্ধারিত হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘বারবার আপনার আকাশের দিকে মুখমন্ডল আবর্তন আমি অবশ্যই লক্ষ করি। সুতরাং এমন কেবলার দিকে আপনাকে প্রত্যাবর্তন করে দেব, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন। অতএব আপনি মসজিদে হারাম (কাবা)-এর দিকে চেহারা ঘুরান। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন ওই (কাবার) দিকেই মুখ ফেরাও।’ -সুরা বাকারা : ১৪৪
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠের নির্দেশনা সংবলিত আয়াতও এ মাসে অবতীর্ণ হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ রাসুল (সা.)-এর প্রতি পরিপূর্ণ রহমত বর্ষণ করেন, ফেরেশতারা রাসুল (সা.)-এর জন্য রহমত কামনা করেন। হে মুমিনরা! তোমরাও তার প্রতি দরুদ পাঠ করো এবং যথাযথভাবে সালাম পেশ করো।’ -সুরা আহজাব : ৫৬
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা রমজান মাসের জন্যে শাবান চাঁদের হিসাব রাখো।’ হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের রোজা ব্যতীত শাবান মাসে অধিক রোজা রাখতেন, অন্য মাসে ততধিক রোজা রাখতেন না। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসকে নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘শাবান আমার মাস, আর রমজান আল্লাহর মাস।’ হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘মধ্য শাবানের রাতে আল্লাহপাক রহমত বর্ষণ করেন এবং তার সমস্ত বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু মুশরিক ও শত্রুতাপোষণকারী ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না।’ -ইবনে মাজাহ
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে তিনি বর্ণনা করেন, নবী কারিম (সা.) হজরত আয়েশা (রা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আয়েশা! শাবান মাসের মধ্যরাতের মর্যাদা ও গুরুত্ব সম্পর্কে তুমি কি জান? তিনি আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাতের কি মর্যাদা? রাসুল (সা.) উত্তরে বললেন, আগামী এক বছরে কতজন আদম সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে, কতজন মৃত্যুবরণ করবে তা এ রাত্রে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর এ রাতে তাদের আমল আল্লাহ দরবারে উপস্থাপন করা হয় এবং তাদের রিজিক অবতীর্ণ কিংবা নির্ধারণ করা হয়। অত:পর হজরত আয়েশা (রা.) বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহ রহমত ছাড়া কারও পক্ষে কি জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়? রাসুল (সা.) বললেন, আল্লাহর বিশেষ রহমত ও একান্ত অনুগ্রহ ছাড়া কারও পক্ষে জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়। এ কথাটি রাসুল (সা.) তিনবার বলেন।’ -মিশকাত
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ১৫ শাবানের দিনে রোজা রাখা এবং রাতে ইবাদতের জন্য বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছেন। হজরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘শাবানের ১৫তম রাতে তোমরা অধিকহারে আল্লাহ ইবাদত করো। অতঃপর দিনের বেলা রোজা পালন করো। সেদিন আল্লাহ সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হন এবং আহ্বান করতে থাকেন, আছো কি কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করবো; আছো কি কোনো রিজিক অন্বেষণকারী, আমি তাকে রিজিক প্রদান করবো; আছো কি কোনো বিপদগ্রস্ত, আমি তাকে বিপদমুক্ত করবো। এমন আরও বিষয়ে কেউ প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তা সবই তোমাদেরকে দান করব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আহ্বান করতে থাকেন।’ -মিশকাত
হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘এক রাতে আমি রাসুল (সা.) কে বিছানায় পেলাম না। এ জন্য তার সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। তারপর আমি জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে নবীজিকে আকাশের দিকে মাথা মোবারক উঠানো অবস্থায় দেখতে পেলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন, হে আয়েশা! তুমি কি এ ধারণা করছো যে, আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) তোমার ওপর অবিচার করেছেন? হজরত আয়েশা (রা.) বললেন, আমি এমন ধারণা করিনি, ভেবেছিলাম আপনি আপনার অন্য কোনো বিবির নিকট গমন করেছেন। তখন রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা শাবানের ১৫ তারিখ রাতে প্রথম আকাশে অবতরণ করেন, অত:পর তিনি বনি কালব গোত্রের মেষের পশমসমূহের চেয়েও বেশি লোকের গোনাহ ক্ষমা করেন।’ -তিরমিজি
এ জন্য শবেবরাতে নফল নামাজ, কাজা নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার, দোয়া-দরুদ, দান-সদকা ও তওবা-ইস্তিগফার করা উত্তম। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘পনেরো শাবান রাত জেগে ইবাদত করো এবং পরদিন রোজা রাখো। এ রাত্রে আপনজনদের কবর জিয়ারত করো।’ তাই পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের কবর জিয়ারত করা। তবে কবর জিয়ারতের উদ্দেশে দলবেঁধে যাওয়া, রাতের লম্বা একটা সময় ব্যয় না করা। কেননা, ‘হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কে হজরত আয়েশা (রা.) শাবানের ১৫ তারিখ রাতে জান্নাতুল বাকিতে মোনাজাতরত অবস্থায় পেয়েছেন।’
শবেবরাতে তওবা-ইস্তেগফার ও নফল ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন মুমিনের কর্তব্য। এ রাতে নানাবিধ গর্হিত কাজ করা, আতশবাজি, অতিরিক্ত আলোকসজ্জা, পোলাও-বিরানি ও হালুয়া-রুটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া ইসলামে নিষিদ্ধ। এ রাত ইবাদতের রাত, কোনো আনন্দ-উৎসবের রাত নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন